test

নারায়ণ ও নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে[১] নমস্কার করিয়া জয়[২] উচ্চারণ করিবে।

১. টীকাকার নীলকণ্ঠের মতে প্রণাম পাঁচটি;–নারায়ণ , নর, নরোত্তম, দেবী এবং সরস্বতী

২. জয় শব্দের অর্থ জয়গ্রন্থ, ‘জয়’ শব্দমাত্র নহে। অষ্টাদশ পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, বিষ্ণুধর্ম্ম ও শিবধর্ম্ম এই সকল জয়গ্রন্থ মধ্যে গণ্য।

নৈমিষারণ্যে সূতের আগমন

কোন সময়ে নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌনক দ্বাদশবার্ষিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। একদা মহর্ষিগণ দৈনন্দিন কর্ম্ম সমাধানপূর্ব্বক সকলে সমবেত হইয়া কথাপ্রসঙ্গে সুখে অধ্যাসীন হইয়া আছেন, ইত্যবসরে লোমহর্ষণ-পুৎত্র পৌরাণিক সৌতি অতি বিনীতভাবে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণ তাঁহাকে অভ্যাগত দেখিয়া অত্যাশ্চর্য্য কথা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। উগ্রশ্রবাঃ সৌতি কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাদিগকে অভিবাদন করিয়া তপস্যার কুশল জিজ্ঞসা করিলেন। তাঁহারাও অতিথির যথোচিত পূজা করিয়া বসিবার নিমিত্ত আসন প্রদানপূর্ব্বক আপনারাও যথাস্থানে উপবেশন করিলেন। অনন্তর সৌতি নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ট হইলে ঋষিরা তাঁহাকে বিশ্রান্ত দেখিয়া কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন. “হে কমললোচন সূতনন্দন! এখন কোথা হইতে আসিতেছ এবং এতকাল কোন্ কোন্ স্থানেই বা পর্য্যটন করিলে, তাহা আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বল।” সৌতি এরূপ জিজ্ঞাসিত হইলে অতি শান্তপ্রকৃতি ঋষিদিগের সমক্ষে কহিতে লাগিলেন, “হে মহর্ষিগণ! আমি মহাত্মা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে গমন করিয়াছিলাম। তথায় বৈশম্পায়নের মুখে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন [ বেদব্যাস] প্রোক্ত মহাভারতীয় কথা শ্রবণ করিলাম। অনন্তর তথা হইতে প্রস্থান করিয়া বহুবিধ তীর্থ দর্শন ও অনেক আশ্রমে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে সমন্তপঞ্চক [কুরুক্ষেত্র] তীর্থে উপস্থিত হইলাম;– পূর্ব্বে যথায় কুরু ও পাণ্ডব এবং উভয়পক্ষীয় ভূপালদিগের তুমুল সংগ্রাম হইয়াছিল। তথা হইতে আপনাদিগের দর্শানার্থে এই পবিত্র আশ্রমে আসিয়াছি। তথা হইতে আপনাদিগের দর্শনার্থে এই পবিত্র আশ্রমে আসিয়াছি। যেহেতু, আপনারা আমার পক্ষে সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ। হে তেজস্বী ঋষিগণ! আপনারা যজ্ঞে আহুতি প্রদান করিয়া অতি পূতমনে আসনে উপবেশন করিয়া আছেন; অনুমতি করুন, ধর্ম্মসম্বন্ধীয় পৌরাণিকী কথা কি ভূপতিদিগের ইতিবৃত্ত বা ঋষিদিগের ইতিহাস, ইহার মধ্যে কি বর্ণন করিব?” ঋষিগণ কহিলেন, “ভগবান্ বেদব্যাস যে ইতিহাস কহিয়াছেন, সুরগণ ও ব্রহ্মর্ষিগণ যাহা শ্রবণ করিয়া অশেষ প্রশংসা করেন এবং বৈশম্পায়ন সর্পযজ্ঞে জনমেজয়ের নিকট যাহা কীর্ত্তন করিয়াছেন, আমরা সেই ইতিহাস শ্রবণ করিতে সাতিশয় অভিলাষ করি। কারণ, যাহা সকল উপাখ্যান হইতে শ্রেষ্ঠ ও নানাশাস্ত্রের সার-সঙ্কলন করিয়া রচিত ও বেদচতুষ্টয়ের অনুগত হইয়াছে এবং যাহাতে আত্মতত্ত্ববিষয়ক সম্যক্ মীমাংশা আছে, তাহা শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে শ্রবণ করিলে পাপভয়ের নিবারণ হয়।” ঋষিগণের প্রার্থনা-বাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, যিনি এই অখণ্ড প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের আদিপুরুষ ও অদ্বিতীয় অধীশ্বর, যিনি স্থাবর-জঙ্গম সকলের স্রষ্টা ও পাতা [রক্ষক], শাস্ত্রে যাঁহাকে একমাত্র পরব্রহ্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করে, যাঁহার প্রীতির নিমিত্ত কেহ প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে মন্ত্রোচ্চারণপুর্ব্বক বারংবার আহুতি প্রদান করিতেছেন, যাঁহার সাক্ষাৎকারলাভপ্রত্যাশায় কেহ বা শত শত বৎসর নির্জ্জনে একান্তমনে ধ্যান, মনন ও অতি কঠোর ব্রতাদির অনুষ্ঠান করিতেছেন, কেহ বা মায়াপ্রপঞ্চস্বরূপ সংসারে বিরক্তিভাব প্রকাশ করিয়া যাঁহার উপাসনার নিমিত্ত আত্মীয়-স্বজন সকলকেই বিসর্জ্জন করিয়া অরণ্যে অরণ্যে ভ্রমণ করিতেছেন, এইরূপ যাঁহাকে লাভ করিবার নিমিত্ত এই পৃথিবীস্থ সমস্ত লোকেই অতি দুষ্কর কর্ম্মে হস্তক্ষেপণ করিতেছে, –সেই অনাদি, অনন্ত, অভিলষিত-ফলদাতা, বিশ্বপাতা [বিশ্বপালক], চরাচরগুরু হরির চরণে প্রণিপাত করিয়া বেদব্যাস- প্রণীত অতি পবিত্র বিচিত্র ইতিহাস বর্ণন করিব। এই বিশাল মহীতলে কতশত মহাত্মারা ঐ ইতিহাস কহিয়া গিয়াছেন, অনেকেই কহিতেছেন এবং ভবিষ্যৎকালেই কহিবেন। ব্রাহ্মণেরা বহুকষ্টে ও অভিনিবিষ্টচিত্তে সংক্ষেপে বা সবিস্তারে যে বেদ অধ্যায়ন করিয়া থাকেন, যাহা জ্ঞানের একমাত্র সীমা, সেই বেদশাস্ত্রের অনুগত করিয়া এই ইতিহাস মহাত্মা বেদব্যাস কর্ত্তৃক বিরচিত হইয়াছে। ইহাতে শাস্ত্রের মত ও লৌকিক আচার-ব্যবহারের রীতিনীতি স্পষ্টরূপে নির্দ্দিষ্ট আছে। ইহা নানা সুচারু শব্দ ও রমণীয়ভাবে পরিপূর্ণ এবং নানাপ্রকার ছন্দোবন্ধে নিবদ্ধ ও অলঙ্কৃত হইয়াছে। এই নিমিত্ত পণ্ডিতমণ্ডলী মহাভারতের সবিশেষ সমাদর করিয়া থাকেন।

সৃষ্টিবর্ণন

প্রথমতঃ এই বিশ্বসংসার কেবল ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত ছিল। অনন্তর সমস্ত বস্তুর বীজভূত এক অণ্ড প্রসূত হইল। ঐ অণ্ডে অনাদি, অনন্ত, অচিন্তনীয়, অনির্ব্বচনীয়, সত্যস্বরূপ, নিরাকার, নির্ব্বিকার, জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম প্রবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ঐ অণ্ডে ভগবান্ প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং জন্ম পরিগ্রহ করিলেন। তৎপরে স্থাণু, স্বায়ম্ভূব মনু, দশ প্রচেতা, দক্ষ, দক্ষের সপ্ত পুৎত্র, সপ্তর্ষি, চতুর্দ্দশ মনু জন্মলাভ করিলেন। মহর্ষিগণ একতানমনে [একাগ্রচিত্তে] যাঁহার গুণকীর্তন করিয়া থাকেন, সেই অপ্রমেয় [পরিমাণ-শূন্য] পুরুষ, দশ বিশ্বদেব, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, যমজ অশ্বিনীকুমার, যক্ষ, সাধুগণ (সাধ্যগণ), পিশাচ, গুহ্যক এবং পিতৃগণ উৎপন্ন হইলেন। অনন্তর অনেকানেক বিদ্বান্ মহর্ষি ও রাজর্ষিগণ উৎপন্ন হইলেন। তৎপরে জল, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, দশ দিক্, সংবৎসর, ঋতু, মাস, পক্ষ, রাত্রি ও অন্যান্য সমস্ত বস্তু ক্রমশঃ সঞ্জাত হইল। কিন্তু প্রলয়কাল উপস্থিত হইলে এই বিশাল বিশ্বসংসার সমুদয়ই সেই একমাত্র পরব্রহ্মে লীন হইবে, আর কোন চিহ্নই থাকিবে না। যাদৃশ কোন ঋতুর পর্য্যায়কালে সমুদয় ঋতুলক্ষণ একৈকশঃ [এক এক ক্রমে] পরিদৃশ্যমান হয়, তাদৃশ যুগপ্রারম্ভে জীবজন্তু ও অন্যন্য সমস্ত পদার্থই স্ব স্ব আকার ও স্বভাব পরিগ্রহ করে। একবার প্রলয়, পুনর্ব্বার উৎপত্তি ও স্থিতি, এইরূপে সংসারচক্র নিরবচ্ছিন্ন ঘূর্ণায়মান হইতেছে।

ত্রয়স্ত্রিংশৎ সহস্র, ত্রয়স্ত্রিংশৎ শত ও ত্রয়স্ত্রিংশৎসংখ্যক দেবতাগণ সংক্ষেপে সৃষ্টি হইলেন। বৃহদ্ভানু, চক্ষু, আত্মা, বিভাবসু, সবিতা, ঋচীক, অর্ক, ভানু, আশাবহ, রবি, মহ্য। এই কয়েকটি দিবের পুৎত্র। মহ্যের পুৎত্র দেবভ্রাট ও সুভ্রাট। সুভ্রাটের তিনপুৎত্র;– দশজ্যোতি, শতজ্যোতি ও সহস্রজ্যোতি। মহাত্মা দশজ্যোতির দশ সহস্র পুৎত্র জন্মে। শতজ্যোতির তাহা অপেক্ষা দশগুণ এবং সহস্রজ্যোতির শতজ্যোতি অপেক্ষা দশগুণ পুৎত্র হয়। এইসকল হইতে কুরুবংশ, যদুবংশ, ভরতবংশ, যযাতিবংশ ও ইক্ষ্বাকুবংশ এবং অন্যান্য প্রভূত রাজর্ষিবংশ সম্ভূত হয়।

যে সকল জীব সৃষ্ট হইল, তাহাদিগের অবস্থিতির স্থান, ত্রিবিধ রহস্য, চারি বেদ, যোগশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র, ধর্ম্মার্থ-কাম-প্রতিপাদক বিবিধ শাস্ত্র, লোকযাত্রাবিধান এই সমস্ত মহাত্মা বেদব্যাস যোগবলে অবগত ছিলেন। এই মহাভারতে অশেষ ইতিহাস ও বেদপ্রতিপাদ্য সনাতন ধর্ম্ম এবং তত্ত্বজ্ঞান বিস্তরতঃ ও সঙ্ক্ষেপতঃ কথিত আছে। কোন কোন কৃতবিদ্য ব্রাহ্মণ মহাভারতের প্রথমাবধি, কেহ বা আস্তীকপর্ব্বাবধি, কেহ বা উপরিচর রাজার উপাখ্যানাবধি আরম্ভ বিবেচনা করিয়া পাঠ করিয়া থাকেন। কেহ কেহ ইহার নিগূঢ় মর্ম্ম বিশেষ অনুধাবন করিয়া সুপ্রচার করেন। কেহ মহাভারতের ব্যাখ্যা করিতে সক্ষম; কেহ বা ইহার ধারণায় সুনিপুণ।

সত্যবতীসুত ব্যাসদেব তপোবলে সনাতন বেদশাস্ত্রের সারোদ্ধার করিয়া এই পবিত্র ইতিহাস রচনা করেন। রচনা করিয়া কি প্রকারে শিষ্যদিগকে অধ্যয়নাদি করাইবেন, এইরূপ মনে মনে চিন্তা করিতেছেন, ইত্যবসরে সর্ব্বজ্ঞ, সর্ব্বশক্তিমান, ভগবান্ প্রজাপতি ব্রহ্মা সত্যবতীতনয়ের চিন্তার বিষয় জানিতে পারিয়া তাঁহার প্রীতিবর্দ্ধন ও লোকের হিতসাধনের নিমিত্ত তথায় আবির্ভূত হইলেন। ব্যাসদেব তাঁহার দর্শনমাত্র অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক তাঁহাকে বসিবার নিমিত্ত এক আসন প্রদান করিয়া অতি বিনীতভাবে দণ্ডায়মান রহিলেন। হিরণ্যগর্ভ আসনপরিগ্রহ করিয়া তাঁহাকে বসিতে অনুমতি করিলে, বেদব্যাস তাঁহার আসনের সন্নিধানে অতি প্রীতিমনে ও প্রফুল্লনয়নে উপবেশন করিয়া সবিনয়ে নিবেদন করিলেন, “ভগবান্! আমি এক অদ্ভুত কাব্য রচনা করিয়াছি; তাহাতে বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষৎ এই সকলের সার-সঙ্কলন; ইতিহাস ও পুরাণের অনুসরণ ও ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান কালত্রয়ের সম্যক্‌ নিরূপণ করিয়াছি এবং জরা, মৃত্যু, ভয়, ব্যাধি, ভাব, অভাব, ইহাদের নির্ণয়; বিবিধ ধর্ম্ম ও আশ্রম-লক্ষণের নিদর্শন, চাতুর্ব্বর্ণ্যবিধান, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য, পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ, নক্ষত্র, তারা ইহাদিগের বিবরণ করিয়াছি। ভূতভাবন ভগবান্ যে নিমিত্ত দিব্য ও মানুষাকারে জন্ম স্বীকার করেন, তাহার তত্ত্বানুসন্ধান, অতি পবিত্র পুণ্যক্ষেত্র ও তীর্থস্থান, ইহারও কীর্ত্তন করিয়াছি। নদ, নদী, সমুদ্র, পর্ব্বত, গ্রাম, নগর, বন, উপবন ইহাদের যথাস্থানে সংস্থান এবং যুদ্ধকৌশল, জাতিবিশেষ, লোকযাত্রাবিধান এই সকলেরও সুস্পষ্ট নিরূপণ করিয়াছি; কিন্তু এই বিশাল বিশ্বক্ষেত্রে একজন ইহার উপযুক্ত লেখক দেখিতেছি না।”

ভারতলেখনার্থে গণেশের স্মরণ

ব্রহ্মা তাঁহার অভিমত বিষয় অবগত হইয়া কহিলেন, “বৎস! এই ভূমণ্ডলে অনেকানেক মহানুভব মুনি আছেন, কিন্তু তুমি তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন বলিয়া ঐ সকল অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। তুমি জন্মাবধি সত্য বৈ কখন মিথ্যা ব্যবহার কর নাই এবং সর্ব্বদা ব্রহ্মবাদিনী বাণী মুখে উচ্চারণ করিয়া থাক; এক্ষণে যখন স্বপ্রণীত মহাভারতকে কাব্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিলে, সুতরাং এই গ্রন্থ কাব্য বলিয়া পরিগণিত ও প্রখ্যাত হইবে। যাদৃশ অপরাপর আশ্রম হইতে গৃহস্থাশ্রম শ্রেষ্ঠ, তাদৃশ তোমার এই কাব্য অন্যান্য কবির কাব্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হইবে সন্দেহ নাই। অ্তএব এক্ষণে গণেশকে স্মরণ কর, তিনি তোমার লেখক হইবেন।” এই কথা বলিয়া ব্রহ্মা অন্তর্হিত হইলে ভগবান্ সত্যবতীসুত গণেশকে স্মরণ করিলেন। গণপতি স্মৃতিমাত্রেই তথায় উপস্থিত হইলে ব্যাসদেব ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে তাঁহার যথোচিত সৎকার ও আসন প্রদান করিয়া কহিলেন, “হে গণনায়ক! মনঃসঙ্কল্পিত মহাভারতাখ্য গ্রন্থ আমি অবিকল বলিতেছি, আপনি তাহার লেখক হউন।” বিঘ্ননাশক গণেশ বেদব্যাসের এই কথা শুনিয়া কহিলেন. “মুনে! যদি লিখিতে লেখনী ক্ষণমাত্র বিশ্রাম লাভ না করে, তাহা হইলে আমি আপনার লেখক হইতে পারি”। ব্যাসদেব কহিলেন, “হে বিঘ্ননাশক! কিন্তু আমি যাহা বলিব, তাহার যথার্থ অর্থবোধ না করিয়া আপনিও লিখতে পারবেন না।” গণাধিপতি তাহাতেই সম্মতি প্রদান করিলেন। এই কারণে ব্যাস স্থানে স্থানে গ্রন্থগ্রন্থি [গঁট-কঠিন] স্বরূপ কূটশ্লোক রচনা করিয়াছেন এবং তদ্বিষয়ে এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়া কহেন যে, এই ভারত-গ্রন্থে অষ্ট সহস্র ও অষ্টশত এরূপ শ্লোক আছে যে, তাহার ভাবার্থ সঙ্কলন করিতে কেবল আমি পারি ও শুক পারে, সঞ্জয় পারেন কি না, তাহা সন্দেহস্থল। অস্পষ্ট বলিয়া ঐ ব্যাসকূটের অদ্যাপি কেহ অর্থ করিতে পারে না। অধিক কি, গণেশ সর্ব্বজ্ঞ হইলেও লিখিবার সময় সেই সকল শ্লোকের অর্থবোধ করিবার নিমিত্ত ক্ষণকাল চিন্তিত হইতেন। ইত্যবসরে ব্যাসদেব বহুতর শ্লোক রচনা করিতেন।

প্রথমতঃ লোক-সকল অজ্ঞানতিমিরে সমাচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু এই মহাভারত জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা দ্বারা সেই মোহাবরণ উন্মোচন করিয়া ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ সংক্ষেপে ও সবিস্তারে কীর্ত্তন করিয়া জীবলোকের মোহান্ধকার নিরাকরণ করিয়াছে। পুরাণরূপ পূর্ণচন্দ্র উদয় হইয়া শ্রুতিস্বরূপ জ্যোৎস্না প্রকাশ করিয়াছে। তদ্দ্বারা লোকের বুদ্ধিরূপ কুমুদ বিকাশ পাইয়াছে। মোহতিমির নিরাস করিয়া এই ইতিহাসস্বরূপ উজ্জ্বল প্রদীপ এই বিশাল বিশ্বস্বরূপ বাসগৃহকে সুপ্রকাশ করিয়াছে।

এই মহাভারত একটি বৃক্ষস্বরূপ। সংগ্রহাধ্যায় ইহার বীজভূত, পৌলোম ও আস্তীকপর্ব্ব ইহার মূল, সম্ভবপর্ব্ব স্কন্ধ, সভা ও অরণ্য ইহার বিটঙ্ক [পক্ষিগণের আশ্রয়স্থান], অরণীপর্ব্ব পর্ব্বস্বরূপ, বিরাট ও উদ্‌যোগপর্ব্ব ইহার সার, ভীষ্মপর্ব্ব শাখা, দ্রোণপর্ব্ব পত্র, কর্ণপর্ব্ব পুষ্পস্বরূপ, শল্যপর্ব্ব সুগন্ধ, স্ত্রী ও ঐশিকপর্ব্ব ইহার সুশীতল ছায়া, শান্তিপর্ব্ব ইহার মহাফল, অশ্বমেধ অমৃতরস, আশ্রমবাসিকপর্ব্ব ইহার আশ্রয়স্থান, শল্যপর্ব্ব এই বৃক্ষের অগ্রভাগ। যেমন মেঘ সকলের উপজীব্য, তাদৃশ এই অক্ষয় ভারতবৃক্ষ উত্তরকালে সকল কবিকূলের উপজীব্য হইবে। এক্ষণে এই মহাভারত-মহাদ্রুমের সুস্বাদু ফল ও সুগন্ধি পুষ্পসমুদয় বলিব।

ধৃতরাষ্ট্রাদির জন্ম

অতি পূর্ব্বকালে ভগবান্‌ বাদরায়ণি [বেদব্যাস]-জননী সত্যবতীর অনুমতিক্রমে এবং ধর্মাত্মা ভীষ্মদেবের নিয়োগানুসারে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে [পত্নীতে] অগ্নিত্রয়প্রতিম অতি বীর্য্যবান তিন সন্তান উৎপাদন করেন। ঐ পুৎত্রত্রয়ের নাম ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর। মহর্ষি ইঁহাদিগকে উৎপাদন করিয়া পুনর্ব্বার তপস্যার নিমিত্ত আশ্রমে প্রস্থান করিয়াছিলেন। অনন্তর ঐ তিন পুৎত্র জরাগ্রস্থ হইয়া লোকান্তরে গমন করিলে মহর্ষি নরলোকে এই পবিত্র ভারত সুপ্রচার করেন। পরে ব্যাসদেব সর্পসত্রকালে রাজা জনমেজয় ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ কর্ত্তৃক প্রার্থিত হইয়া স্বশিষ্য বৈশম্পায়নকে ভারত কহিতে অনুমতি করেন। বৈশম্পায়ন আহ্নিক-কর্ম্ম-সমাধান্তে সেই মহতী সভায় উপবেশন করিয়া ভারত কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন।

মহাভারতের সংক্ষিপ্তসার

কুরুবংশীয়দিগের ইতিবৃত্ত, গান্ধারীর ধর্ম্মশীলতা, বিদুরের বুদ্ধি, কুন্তীর ধৈর্য্য, বাসুদেবের [কৃষ্ণ] মাহাত্ম্য, পাণ্ডবদিগের সরলতা, ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের দুর্ব্বৃত্ততা, স্বগ্রন্থে দ্বৈপায়ন এই সকল অবিকল বর্ণন করিয়া গিয়াছেন। ভরতসংহিতা প্রথমতঃ চতুর্ব্বিংশতিসহস্র শ্লোকে বিরচিত হয়। তাহাতে উপাখ্যানভাগ এককালে পরিত্যক্ত হইয়াছিল। পরিশেষে মহর্ষি সার্দ্ধশতশ্লোকময়ী অনুক্রমণিকায় ভারতীয় নিখিল বৃত্তান্তের সার সঙ্কলন করিলেন।

বেদব্যাসএই মহাভারত প্রস্তুত করিয়াই সর্ব্বাগ্রে স্বীয়পুত্র শুকদেবকে অধ্যয়ন করান। পরে অনুরূপ শিষ্যমণ্ডলীতে তাহা বিতরণ করেন। অনন্তর ষষ্টিলক্ষশ্লোকাত্মক অন্য এক ভারতসংহিতা রচনা করিয়াছিলেন। ঐ ষষ্টিলক্ষের মধ্যে ত্রিংশৎলক্ষ দেবলোকে, পিতৃলোকে পঞ্চদশ, গন্ধর্বলোকে চতুর্দ্দশ এবং নরলোকে একশত সহস্র শ্লোক অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে। নারদ দেবলোকে মহাভারত সুপ্রচার করেন। অসিত ও দেবল পিতৃলোকে ও শুকদেব গন্ধর্ব্ব, যক্ষ ও রাক্ষসদিগকে শ্রবণ করান এবং ব্যাসদেবের শিষ্য বৈশম্পায়ন মনুষ্যলোকে ভারত কীর্ত্তন করেন। হে ঋষিগণ! এক্ষণে আমি আপনাদিগের সমক্ষে তাহাই কীর্ত্তন করেন। হে ঋষিগণ! এক্ষণে আমি আপনাদিগের সমক্ষে তাহাই কহিব।

‌বক্ষ্যমাণ মহাভারতের দুর্য্যোধন ক্রোধময় মহাবৃক্ষ, কর্ণ তাহার স্কন্ধ, শকুনি শাখাস্বরূপ, দুঃশাসন ফল ও পুষ্প, মনস্বী [মূলের পাঠ – ‘ধৃতরাষ্ট্রোন্মনীষী।’ ধৃতরাষ্ট্র অমনীষী– মনস্বিতাশূন্য অর্থাৎ অস্থিরমতি। একপক্ষ নানা ত্রুটিযুক্ত ও অপরপক্ষ সর্ব্বদোষমুক্ত – এই দুইটি ভাবই ইহাতে প্রদর্শিত।] রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাহার মূল। যুধিষ্ঠির ধর্ম্মময় মহাবৃক্ষ অর্জ্জুন স্কন্ধ, ভীমসেন তাহার শাখা, মাদ্রীসূত নকুল-সহদেব তাহার পুষ্প ও ফল এবং কৃষ্ণ, ব্রহ্ম ও ব্রাহ্মণগণ তাহার মূল।

রাজা পাণ্ডু বুদ্ধি ও বিক্রমপ্রভাবে নানাদেশ অধিকার করিয়া অবশেষে বনবাসী ঋষিদিগের সহিত অরণ্যে মৃগয়ারস-পরবশ হইয়া কালযাপন করিতে লাগিলেন। একদা মৃগয়াকালে সম্ভোগাসক্ত একটি মৃগকে লক্ষ্য করিয়া শরক্ষেপ করিলে ঐ মৃগ মৃত্যুকালে তাঁহাকে এইরূপে অভিসম্পাত দিল, –”মহারাজ! আপনি সম্ভোগ সময়ে যেমন আমার প্রাণসংহার করিলেন, তাদৃশ আপনিও অতঃপর সম্ভোগসুখ অনুভব করিতে পারিবেন না; তাহা হইলে নিশ্চয়ই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইবেন।” সুতরাং তদবধি অনপত্যতা [সন্তানহীনতা] নিবন্ধন তিনি অত্যন্ত বিপদে আক্রান্ত হইলেন। অগত্যা ধর্ম্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারের ঔরসে পাণ্ডবদিগের জন্মলাভ হইল। কুন্তী ও মাদ্রী ঋষিদিগের সেই পরম পবিত্র আশ্রমে পাণ্ডবগণকে লালন-পালন করিতে লাগিলেন। অনন্তর ঋষিরা জটাবল্কলধারী পাণ্ডবগণকে রাজধানীতে ধৃতরাষ্ট্রাদির নিকটে উপনীত করিয়া কহিলেন, ইহারা পাণ্ডুপুৎত্র; অরণ্যে আমাদিগের প্রযত্নে রক্ষিত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে। ইহারা আপনাদিগের পুৎত্র, মিত্র, শিষ্য, সুহৃৎ ও ভ্রাতাস্বরূপ।” এই বলিয়া ঋষিরা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। তাঁহারা পঞ্চপাণ্ডবকে এইরূপে সকলের পরিচিত করিয়া অন্তর্হিত হইলে কৌরব ও পুরবাসিগণ সহর্ষে সকলেই মহা কোলাহল করিতে লাগিল। তন্মধ্যে কেহ কহিল, ‘ইহারা তাঁহার সন্তান নহে।’ কেহ কেহ কহিল, ‘তাঁহারই বটে।’ কেহ কেহ বলিল, বহুকাল হইল, পাণ্ডু রাজা লোকান্তরিত হইয়াছেন; সুতরাং ইহারা তাঁহার পুৎত্র, ইহাই বা কি প্রকারে সম্ভবপর হইতে পারে? যাহা হউক, ভাগ্যক্রমে আমরা অদ্য পাণ্ডুরাজের সন্ততি দেখিলাম।’ এইরূপ কথাই সকল স্থানে লোকের মুখ হইতে নির্গত হইতে লাগিল। ঐ কোলাহল নিবৃত্ত হইলে আকাশবাণী হইল; পুষ্পবর্ষণসহকারে সুগন্ধ সমীরণ সঞ্চারণ করিতে লাগিল। ফলতঃ পাণ্ডুপুৎত্রদিগের নগরপ্রবেশকালে এই সকল শুভলক্ষণ স্পষ্টই লক্ষিত হয়। পুরবাসিগণ এই সকল অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া অতিশয় হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিল।

অনন্তর পাণ্ডবেরা নিখিল বেদ ও বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়নকরতঃ পূজিত ও প্রশংসিত হইয়া অকুতোভয়ে তথায় বাস করিতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠিরের বিশুদ্ধ আচার ও ব্যবহারে, ভীমসেনের ধৈর্য্যে, অর্জ্জুনের বিক্রমে, কুন্তীর গুরুশুশ্রূষায়, নকুল ও সহদেবের বিনয় ও শৌর্য্যগুণে প্রকৃতিরা [প্রজাগণ] অতি প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছিল। অনন্তর অর্জ্জুন সমাগত সমস্ত ভূপালসম্মুখে অতি অদ্ভুত ব্যাপার সমাধান করিয়া স্বয়ংবরা কন্যা দ্রৌপদীকে আনয়ন করিলেন। তদবধি অর্জ্জুন সকল ধনুর্দ্ধারীদিগের মধ্যে পূজ্য হইলেন এবং সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলে প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হইতেন; কেহই তাঁহার দুর্ব্বিষহ বীর্য্য সহ্য করিতে পারত না। মহাবীর অর্জ্জুন নিজভুজবলে সমস্ত ভূপতিদিগকে পরাজয় করিয়া যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন।

অনন্তর যুধিষ্ঠির বাসুদেবের [কৃষ্ণ] সৎপরামর্শে, ভীমসেন ও অর্জ্জুনের বাহুবলে দুর্দ্দান্ত জরাসন্ধ ও শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক পরাক্রান্ত শিশুপালের বধসাধন করিয়া দীনদুঃখীদিগকে অন্নদান ও যজ্ঞান্তে ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণা-দান করিয়া নিরাপদে রাজসূয় মহাযজ্ঞ সমাপন করিলেন। দেশ-দেশান্তর হইতে পাণ্ডবদিগের নিকট মণি, কাঞ্চন, গো, হস্তী, অশ্ব, বিচিত্র বসন, কম্বল, প্রাবার [উত্তরীয় বস্ত্র], আবরণ ও আস্তারণ রাশি রাশি এই সকল উপঢৌকন আসিতে লাগিল। তখন পাণ্ডবদিগের অপেক্ষাকৃত উন্নতি ও সম্পত্তি দেখিয়া দুর্ম্মতি দুর্য্যোধনের মনোমধ্যে অত্যন্ত ঈর্ষা জন্মিল। বিশেষতঃ ময়দানব-নির্ম্মিত পরমাশ্চর্য্য সভা দেখিয়া তিনি যথোচিত পরিতাপ পাইলেন। সভাপ্রবেশকালে জলে স্থল ও স্থলে জলভ্রম হইলে বাসুদেবের সমক্ষে দুর্য্যোধন নিতান্ত নীচের ন্যায় ভীম-কর্তৃক উপহসিত ও অপমানিত হওয়াতে অশেষভোগসুখসম্পন্ন হইলেও দিন দিন বিবর্ণ, কৃশ ও শ্রীভ্রষ্ট হইতে লাগিলেন। পুৎত্রবৎসল ধৃতরাষ্ট্র দুর্য্যোধনের অভিমত অবগত হইয়া তাঁহার মনোদুঃখ দূর করিবার নিমিত্ত দ্যূতক্রীড়ার অনুজ্ঞা দিয়াছেন। ইহা শুনিয়া শ্রীকৃষ্ণের অন্তঃকরণে ক্রোধের সঞ্চার হইল। তাহাতে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেও বিবাদের অনুমোদন করিয়া দ্যূত প্রভৃতি দুর্নীতির উপেক্ষা করিলেন, তাহা নিবারণ করিবার কোনও উপায় অবধারণ করিলেন না। সুতরাং বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যের অনভিমতে ক্ষত্রিয়বংশ ধ্বংস হইল।

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদিগের বিজয়বার্ত্তা শ্রবণ ও দুর্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনির অভিমত বিষয় স্মরণ করিয়া সঞ্জয়কে কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি তোমাকে সমুদয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। কিন্তু আমার কথা শুনিয়া সহসা অসূয়াপরবশ হইও না। দেখ, আমার জ্ঞাতিবিবাদে সম্মতি নাই এবং সমক্ষে কুলক্ষয় হয়, আমি তাহাতেও প্রীত নহি। আমার পুৎত্র এবং পাণ্ডুর পুৎত্র বলিয়া অদ্যাবধি উভয়পক্ষে কোনরূপ বিভিন্নভাব প্রদর্শন করি নাই। তথাপি পুৎত্রেরা ক্রোধপরায়ণ হইয়া বৃদ্ধ বলিয়া আমাকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করে। আমি অন্ধ, সুতরাং পুৎত্রবৎসলতাবশতঃ সকলই সহ্য করিয়া থাকি। দুর্য্যোধন বিমহিত হইলে আমিও মোহে অভিভূত হই। দুর্য্যোধন মহানুভব পাণ্ডবদিগের রাজসূয়যজ্ঞে তাদৃশ সমৃদ্ধি দেখিয়া এবং সভাপ্রবেশকালে সেইরূপ উপহসিত হইয়া রুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হইল। ক্ষৎত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া রণস্থলে পাণ্ডবাদিকে জয় করিতে অক্ষম ও সমস্ত রাজ্য-সম্পত্তি আত্মসাৎ করিতে পরান্মুখ হইয়া পরিশেষে গান্ধাররাজের পরামর্শ গ্রহণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের সহিত কপট দ্যূতক্রীড়া করিয়া সাম্রাজ্য অধিকার করিবার কল্পনা করিল। হে সঞ্জয়! আমি সে বিষয়ের যাহা কিছু জানি, তাহা অবিকল কহিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি গুণজ্ঞ, মেধাবী ও বুদ্ধিমান; সুতরাং যুক্তিসঙ্গত কথা শুনিয়া অবশ্যই আমার বিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাইবে।”

ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ

“যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন ধনুর্গুণ আকর্ষণপূর্ব্বক অসংখ্য রাজগণ সমক্ষে লক্ষ্যভেদ করিয়া তাহা ভূতলে পাতিত ও দ্রৌপদীকে বরণ করিয়াছে, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন দ্বারকায় স্ববিক্রম-প্রভাবে সুভদ্রার পাণিগ্রহণ করিয়াছে, তথাপি বৃষ্ণিবংশাবতংস কৃষ্ণ-বলরাম তাদৃশ ঘৃণিত ও নিন্দিত কর্ম্মে উপেক্ষা করিয়া পরম সখ্যভাবে ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিয়াছেন, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, দেবরাজ ইন্দ্র নিরবচ্ছিন্ন মুষলধারে বৃষ্টি করিতে লাগিলেন, কিন্তু অর্জ্জুন তাহাতে কিছুমাত্র শঙ্কিত না হইয়া দিব্যশরজাল বিস্তার করিয়া সেই বৃষ্টি নিবারণপূর্ব্বক খাণ্ডবদাহে অগ্নিকে পরিতৃপ্ত করিয়াছেন, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, কুন্তীর সহিত পঞ্চপাণ্ডব জতুগৃহের প্রজ্জ্বলিত হুতাশন হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে এবং অসামান্য ধীশক্তিসম্পন্ন বিদুর তাহাদিগের অভীষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত যত্নবান্ আছে, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, ভীমসেন বাহুবলে বলদৃপ্ত মগধাধিপতি জরাসন্ধকে বধ করিয়াছে এবং দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে অনেকানেক ভূপতিদিগকে বশীভূত করিয়া রাজসূয় মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছে, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, একবস্ত্রা, অশ্রুমুখী, দুঃখিতা, রজস্বলা দ্রৌপদীকে সনাথা হইলেও অনাথার ন্যায় সভায় আনয়ন ও নিতান্ত নির্ব্বোধ দুঃশাসন তাহার পরিধেয় বসন আকর্ষণ করিয়াছে, তথাপি ঐ দুষ্ট বিনষ্ট হয় নাই, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, শকুনি পাশক্রীড়া করিয়া যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত করিয়াছে, তথাপি শান্ত ও সুশীল ভ্রাতৃগণ তাহার অনুগতই আছে, তখন আর জয়ের আশা করি নাই। যখন বনপ্রস্থানকালে জ্যেষ্ঠভক্তিপরায়ণতাপ্রযুক্ত পাণ্ডবদিগকে অশেষক্লেশস্বীকার সহকারে বিবিধ হিতচেষ্টা করিতে শ্রবণ করিলাম এবং ভিক্ষোপজীবী মহাত্মা স্নাতক ব্রাহ্মণগণ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অনুগত আছেন, তখন আর জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন কিরাতরূপী ভগবান্ মহাদেবকে যুদ্ধে প্রীত ও প্রসন্ন করিয়া পাশুপতমহাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছে এবং স্বর্গে দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট যথাবিধানে অস্ত্রশিক্ষা করিয়াছে, তখন আমি আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বরদানদৃপ্ত ও দেবতাদিগের অজেয় পুলোমপু্ৎত্র কালকেয়দিগকে অর্জ্জুন পরাজয় করিয়াছে এবং দুর্দ্দান্ত দানবদল দমন করিবার নিমিত্ত ইন্দ্রলোকে গমন করিয়া কৃতকার্য্য হইয়া প্রত্যাগমন করিয়াছে, তদবধি আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীম ও অন্যান্য পাণ্ডবগণ, যথায় নরলোকের সঞ্চারমাত্র নাই, এইরূপ দুর্গম স্থানে গমন করিয়া কুবেরের সহিত সমাগত হইয়াছে, তখন আর আমার জয়াশা নাই। যখন শুনিলাম কর্ণের পরামর্শ-ক্রমে ঘোষযাত্রাগত মৎপুৎত্রেরা গন্ধর্ব্ব দ্বারা সংযত [বন্ধনপ্রাপ্ত] ও অর্জ্জুন কর্ত্তৃক বিমোচিত হইয়াছে, তদবধি আমার আর জয়াশা নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্ম স্বয়ং যক্ষের আকার স্বীকার করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, বিরাটরাজ স্বসুতা উত্তরাকে অলঙ্কৃতা করিয়া অর্জ্জুনকে সম্প্রদান করিয়াছেন এবং অর্জ্জুনও আপনার পুৎত্রের নিমিত্ত তাহাকে প্রতিগ্রহ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, নির্জ্জিত, নির্ধন, নিষ্কাসিত ও স্বজনবহিষ্কৃত যুধিষ্ঠির সপ্ত অক্ষৌহিণী সেনা সংগ্রহ করিয়াছে এবং বলিকে ছলিবার নিমিত্ত যিনি একপদে এই সম্পূর্ণ পৃথিবী অধিকার করিয়াছেন, সেই ত্রিবিক্রম নারায়ণ তাহার বহুবিধ উদ্দেশ্য সংসাধন করিতেছেন, তখন আমি আর জয়ের আশা করি নাই। যখন নারদমুখে শুনিলাম, কৃষ্ণার্জ্জুন সাক্ষাৎ নরনারায়ণাবতার, তিনি ব্রহ্মলোকে তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করেন, তদবধি আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, বাসুদেব লোকের হিতসাধনের নিমিত্ত কুরুদিগের বিবাদভঞ্জন করিতে গমন করিয়া পরিশেষে চরিতার্থ না হইয়া প্রত্যাগত হইয়াছেন, তদবধি আর আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ ও দুর্য্যোধন কৃষ্ণকে নিগ্রহ করিতে সচেষ্টিত আছে, কিন্তু তিনি আপনার বহুবিধ রূপ প্রদর্শন করিয়া তাহাদিগকে নিচেষ্ট করিয়াছেন, তখন আর জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কৃষ্ণ প্রস্থানকালে নিতান্ত দীনা কুন্তীকে একাকিনী রথের সম্মুখে দণ্ডায়মানা দেখিয়া অশেষ সান্ত্বনাবাক্যে তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়াছেন, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, বাসুদেব ও ভীষ্ম উভয়ে পাণ্ডবদিগের মন্ত্রী হইয়াছেন এবং দ্রোণাচার্য্য কায়মনোবাক্যে নিরবচ্ছিন্ন তাহাদিগের শুভানুধ্যান করিতেছেন, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্মদেব ‘তুমি যুদ্ধ করিলে আমি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না’ কর্ণকে এই কথা কহিয়া সেনাধিকার পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন আর জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন বিষণ্ণ ও মোহাচ্ছন্ন হইলে কৃষ্ণ স্বশরীরে চতুর্দ্দশ ভুবন দর্শন করাইয়াছেন, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্ম প্রতিদিন রণক্ষেত্রে দশসহস্র লোকের প্রাণসংহার করিলেও পাণ্ডবপক্ষীয় বিখ্যত কোন এক ব্যক্তিকে বিনষ্ট করিতে পারেন নাই, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্মপরায়ণ ভীষ্ম, পাণ্ডবদিগের নিকট আপনার বধোপায় অবধারণ করিয়া দিয়াছেন এবং তাহারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া সেই বিষয় সংসাধন করিয়াছে, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়া মহাবলপরাক্রান্ত ভীষ্মকে নিতান্ত নিস্তেজ করিয়াছে, তখন আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্মদেব মৎপক্ষীয় অসংখ্য লোককে বিনষ্ট ও অল্পাবশিষ্ট করিয়া শত্রুপক্ষীয়দিগের সুতীক্ষ্ণশরজালে বিদ্ধকলেবর হইয়া শরশয্যায় শায়িত হইয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ান হইয়া পিপাসাশান্তির নিমিত্ত পানীয় আনয়নার্থ অনুজ্ঞা করিলে অর্জ্জুন ভূমিভেদ করিয়া তাঁহাকে পরিতৃপ্ত করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বায়ু [পবন], ইন্দ্র ও সূর্য্য ইঁহারা পাণ্ডবদিগের অনুকুল আছেন এবং দুরন্ত হিংস্রজন্তুগণ যাত্রাকালে আমাদিগকে নানাপ্রকারে বিভীষিকা প্রদর্শন করিয়া থাকে, তখন আর আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বিচিত্রবীর্য্য দ্রোণাচার্য্য যুদ্ধে নানাবিধ অস্ত্র প্রয়োগনৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়া পঞ্চপাণ্ডবের কাহাকেও বিনষ্ট করিতে পারেন নাই, তখন আমি আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, মহারথ সংসপ্তকগণ, যাহারা অর্জ্জুন-বিনাশের নিমিত্ত ব্যবস্থিত হইয়াছিল, তাহারা তৎকর্তৃক নিহত হইয়াছে, তখন আর আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণাচার্য্য অস্ত্র গ্রহণ করিয়া যাহা সতত সাবধানে সংরক্ষণ করিতেছেন, সেই দুর্ভেদ্য ব্যুহভেদ করিয়া তন্মধ্যে অভিমন্যু অসহায় হইয়া প্রবেশ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সপ্তরথী অর্জ্জুন-বিনাশে অসমর্থ হইয়া অল্পবয়স্ক বালক অভিমন্যুকে বধ করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অভিমন্যুকে বিনষ্ট করিয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা অতিশয় হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট হইলে অর্জ্জুন রোষভরে সিন্ধুরাজ জয়দ্রতকে বিনাশ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন শত্রুসমক্ষে জয়দ্রতকে বধ করিয়া অনায়াসে প্রতিজ্ঞাপাশ হইতে বিমুক্ত হইয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুনের অশ্বচতুষ্টয় একান্ত ক্লান্ত হইলে বাসুদেব বন্ধন উন্মোচন করিয়া তাহাদিগকে জলপান করাইয়া পুনর্ব্বার রথে যোজনা করেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ ধনুর অগ্রভাগ দ্বারা ভীমসেনকে আকর্ষণ করিয়া যথোচিত তিরস্কার করিয়াছেন ও সে অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়া ভাগ্যবলে আপনার প্রাণরক্ষা করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণ, কৃতবর্ম্মা, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা ও শল্য ইঁহারা প্রতীকারে পরাঙ্মুখ হইয়া সমক্ষে জয়দ্রতবধে উপেক্ষা করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দেবরাজদত্ত দিব্য-শক্তি ঘোররূপী রাক্ষস ঘটোৎকচের বধনিমিত্ত প্রযুক্ত হইয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ অর্জ্জুনের বধসাধন করিবার নিমিত্ত যে একপুরুষঘাতিনী শক্তি রাখিয়াছিলেন, তাহা রাক্ষস ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ-ধর্ম্মের বিরুদ্ধ আচরণ করিয়া মরণে স্থিরনিশ্চয়, বিশস্ত্র ও রথস্থিত দ্রোণাচর্য্যের শিরশ্ছেদ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম,অশ্বত্থামার সম্মুখীন হইয়া মাদ্রীসুত নকুল অসংখ্য লোকসমক্ষে ঘোরতর দ্বৈরথ সংগ্রাম করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণবধে ক্রোধে অধীর হইয়া অশ্বত্থামা নারায়াণাস্ত্র পরিত্যাগ করিয়াও পাণ্ডবদিগের প্রধান এক ব্যক্তির প্রাণসংহার করিতে পারিলেন না, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীমসেন যুদ্ধে দুঃশাসনের রুধির পান করিয়াছে এবং দুর্য্যোধন প্রভৃতি অনেকেই তথায় সমুপস্থিত থাকিয়াও তাহা নিবারণ করিতে অক্ষম হইয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন অতি পরাক্রান্ত কর্ণকে সমরশায়ী করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অতি দুর্দ্ধর্ষ দুঃশাসন, মহাবীর্য্য কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামাকে পরাজয় করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, যে শল্য ‘বাসুদেবকে পরাজয় করিব’ বলিয়া সর্ব্বদা স্পদ্ধা করিত, যুদ্ধস্থলে যুধিষ্ঠির তাঁহার প্রাণনাশ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সহদেব কলহ ও দ্যূত প্রভৃতি কতিপয় দুর্নীতির নিদান ও অতি মায়াবী প্রবল সৌবলকে [শকুনি] মৃত্যমুখে প্রত্যর্পণ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দুর্য্যোধন গদাযুদ্ধে সবিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিতেছিল, ইত্যবসরে ভীমসেন আপনার অনুরূপ বিক্রম প্রকাশ করিয়া তাহাকে সমরশায়ী করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অশ্বত্থামা প্রভৃতি কতিপয় বীরপুরুষেরা সমবেত হইয়া দ্রৌপদীর প্রসুপ্ত পুৎত্রপঞ্চক বিনাশ করিয়া অতি ঘৃণিত ও নিন্দিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন ‘স্বস্তি’ বলিয়া অস্ত্র দ্বারা অশ্বত্থামার অমোঘ ব্রহ্মশির অস্ত্র নিবারণ করিয়াছে এবং তাহার তুষ্টিসাধন করিবার নিমিত্ত অশ্বত্থামাও মণিরত্ম পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অশ্বত্থামা মন্ত্রপূত অস্ত্র প্রয়োগ করিয়া্ উত্তরার গর্ভ নাশ করেন, তদুপলক্ষে দ্বৈপায়ন ও বাসুদেব উভয়ে তাঁহাকে অভিশাপ প্রদান করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। এক্ষণে গান্ধারী পুৎত্র, পৌৎত্র, পিতা, ভ্রাতা প্রভৃতি সমুদয় আত্মীয়-স্বজনের নিধনদশায় এতাদৃশ দুরবস্থায় পড়িয়াছেন এবং পাণ্ডবেরা অনায়াসে অতি দুষ্কর কার্য্যের সংসাধন করিয়া পরিশেষে রাজসিংহাসন অধিকার করিয়াছে; এক্ষণে আমাদিগের পক্ষীয় তিনটি ও পাণ্ডবদিগের সাতটি সমুদয়ে দশজন অবশিষ্ট আছে। এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা বিনষ্ট হইয়াছে; হে সঞ্জয়! সেই সমুদয় স্মরণ করিয়া আমি বারংবার মোহে অভিভূত হইতেছি, চারিদিক্ শূন্যময় ও জীবলোক শোকময় বলিয়া এক্ষণে প্রতীয়মান হইতেছে। আমার আর চেতনা নাই। মন বিহ্বল হইতেছে।”

ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সান্ত্বনা

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ বহুবিধ বিলাপ করিয়া সহসা মূর্চ্ছিত হইলেন। অনন্তর চেতনা প্রাপ্ত হইয়া সঞ্জয়কে কহিলেন. “হে সঞ্জয়! এক্ষণে এইরূপ দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়া প্রাণধারণ করা অতি কাপুরুষের কর্ম্ম; বিশেষতঃ আমার জীবনে আর কোন প্রয়োজন দেখিতেছি না, সুতরাং এই অবস্থায় অবিলম্বে দেহবিসর্জ্জন করাই আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর।” রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কাতর দেখিয়া সঞ্জয় কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! দ্বৈপায়ন ও নারদমুখে আপনি শুনিয়াছেন. শৈব্য, সৃঞ্জয়, সুহোত্র, রন্তিদেব, কাক্ষীবান, ঔশিজ, বাহ্লীক, দমন, শর্যাতি, অজিত, নল, বিশ্বামিত্র, অম্বরীষ, মরুত্ত, মনু, ইক্ষ্বাকু, গয়, ভরত, দাশরথি রাম, শশবিন্দু, ভগীরথ, কৃতবীর্য্য, শুভকর্ম্মা, যযাতি ইঁহারা প্রখ্যাত রাজর্ষি-বংশে প্রসূত হইয়া অলৌকিক যশ, অসামান্য কীর্ত্তি ও ধর্ম্মযুদ্ধে জয়লাভ করিয়া পরিশেষে কালবশে এই সুখময় পৃথিবী হইতে অন্তরিত হইয়াছেন। পূর্ব্বকালে শৈব্য রাজা পুৎত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইলে মহর্ষি নারদ এই চতুর্ব্বিংশতি উপাখ্যান তাহার সম্মুখে কীর্ত্তন করেন। তদ্ভিন্ন পুরু, কুরু, যদু, শূর বিশ্বগশ্ব, অণুহ, যুবনাশ্ব, ককুৎস্থ, রঘু, বিজয়, বীতিহোত্র, অঙ্গ, ভব, শ্বেত, বৃহদ্‌গুরু, উশনীর, শতরথ, কঙ্ক, দুলিদুহ, দ্রুম, দম্ভোদ্ভব, বেণ, সগর, সঙ্কৃতি, নিমি, অজেয়, পরশু, পুণ্ড, শম্ভু, দেবাবৃধ, দেবাহ্বয়, সুপ্রতিম, সুপ্রতীক, বৃহদ্রথ, সুক্রতু, নিষধাপতি নল, সত্যব্রত, শান্তভয়, সুমিত্র, সুবল, জানুজঙ্ঘ, অনরণ্য, অর্ক, বলবন্ধু, নিরামর্দ্দ, প্রিয়ব্রত, শুচিব্রত, কেতুশৃঙ্গ, বৃহদ্বল, ধৃষ্টকেতু, বৃহৎকেতু, দীপ্তকেতু, নিরাময়, কৃতবন্ধু, চপল, ধূর্ত্ত, দৃঢ়োষুধি, অবিক্ষিৎ, মহাপুরাণসম্ভাব্য, প্রত্যঙ্গ, পরহা, এই সকল ও অন্যান্যা শত সহস্র সুপ্রসিদ্ধ মহীপাল ছিলেন। ইঁহারা অশেষ-ভোগসুখ বিসর্জ্জন করিয়া নিধনদশায় নিপতিত হয়েন। অনেকানেক সদ্বিদ্বান্ প্রধান কবিগণ প্রাচীন ইতিহাস কহিবার সময় প্রসঙ্গক্রমে এই সকল বলবান্ রাজাদিগের অতুল বিক্রম, সমধিক যশ, মহাত্মতা, সরলতা, আস্তিক্য, সত্য, শৌচ ও দয়া এই সকল বিষয়ের ভূরি ভূরি নিদর্শন দিয়া থাকেন। তাঁহারা সর্ব্বগুণসম্পন্ন হইলেও পরিশেষে মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়াছেন; কিন্তু আপনার পুৎত্রেরা অতিশয় দুর্ব্বৃত্ত, লুব্ধ প্রকৃতি ও রোষপরায়ণ ছিলেন; সুতরাং তাঁহাদিগের সংহারদশায় এইরূপ কাতর হওয়া সমুচিত নহে। বিশেষতঃ আপনি মেধাবী এবং আপনার বুদ্ধি-বৃত্তি নিয়মিত শাস্ত্রানুগামিনী আছে, অ্তএব এইরূপ বিজ্ঞ ও গুণজ্ঞ হইয়া বারংবার শোকে আক্রান্ত ও অভিভূত হওয়া আপনার পক্ষে নিতান্ত নিষিদ্ধ ও অনুপযুক্ত। আপনি দৈবনিগ্রহ ও অনুগ্রহ উভয়ই বিদিত আছেন; যাহা ভবিতব্য, অতি সাবধানে থাকিলেও তাহা ঘটিয়া থাকে; সুতরাং তাহার অনুশোচনা করা অবিধেয়। এই জগতীতলে অদ্যাপি বুদ্ধিবলে কেহই দৈবের প্রতিকূলতাচরণ করিতে পারেন নাই। কারণ, দৈবের অপরিবর্ত্তনীয় নিয়ম অতিক্রম করা কাহারই সাধ্য নহে। ভাব ও অভাব, সুখ ও অসুখ সকলই কালবশে নিয়ত পরিভ্রমণ করিতেছে। কাল সর্ব্বজীবের সৃষ্টি ও কালই তাহার সংহার করিয়া থাকেন, কাল সর্ব্বজীবের দাহ ও কালই তাহার শান্তি করেন। ইহকালে যে সকল শুভাশুভ উপস্থিত হয়, সমুদয় কাল-মূলক। প্রজার সৃষ্ট ও সংহার সকলই কাল-সহকারে ঘটিয়া থাকে। জীবলোকে সকলই নিদ্রিত, একমাত্র কাল জাগরিত আছেন। কাল সর্ব্বত্র সর্ব্বভূতে সমভাবে অবস্থান করিতেছেন। যাহা অতিক্রান্ত বা অনাগত ও যে অবস্থা বর্ত্তমান আছে, সকলই কালকৃত বিবেচনা করিয়া আপনার বিচেতন হওয়া সমুচিত নহে।”

এইরূপ প্রবোধবাক্যে সঞ্জয় পুৎত্রশোক-সন্তপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত ও সুস্থচিত্ত করিলেন। ভগবান্ বেদব্যাস এই বিষয়ের এক পবিত্র উপনিষৎ কহিয়াছেন এবং অতি বিচক্ষণ কবিগণ ঐ উপনিষৎ পুরাণে কীর্ত্তন করেন।

মহাভারত-প্রশংসা

এই মহাভারত অধ্যয়ন করিলে পাপের নাশ ও পুণ্যের সঞ্চার হইয়া থাকে। অধিক কি, শ্লোকের একচরণ উচ্চারণ করিলেও পাপভয়ের নিবারণ হয়। এই গ্রন্থে দেব, দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, যক্ষ ও রাক্ষস, ইহাদেগের বিচিত্র ইতিহাস বর্ণিত আছে। যিনি একমাত্র পবিত্র ও সত্যস্বরূপ নিত্য পরব্রহ্ম, পণ্ডিতেরা যাঁহার অদ্ভুত রচনার ঘোষণা করিয়া থাকেন, যিনি কার্য্য-কারণ-রূপ বিশ্বের নিয়ন্তা, যে অপ্রমেয় পুরুষের সুশাসন অস্খলিত ও অপ্রতিহতপ্রভাবে বিদ্যমান থাকিয়া এই বিশাল বিশ্বের নিরবচ্ছিন্ন শভসংসাধন করিতেছে, যিনি জন্মমৃত্যরূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে সংযত করিয়া সর্ব্বজীবের সৃষ্টি করিয়াছেন, ঋষিগণ যোগবলে আদর্শ [আয়না]-তলগত প্রতিবিম্বের ন্যায় অন্তরে যাঁহার বিশ্বরূপ সন্দর্শন করিয়া ভূমানন্দ [ব্রহ্মানন্দ] উপভোগ করেন, যাঁহার তুষ্টির নিমিত্ত নিত্য ও নৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ সকলই অনুষ্ঠিত হয়, সেই অনাদি, অনন্ত, ভূতভাবন ভগবান্ বাসুদেবের সুপরিচিত এই গ্রন্থে সম্যকরূপে কীর্ত্তিত আছে। ধর্ম্মপরায়ণ ও পরমশ্রদ্ধাবান্ নর নিয়মপূর্ব্বক এই অধ্যায় পাঠ করিলে পাপ হইতে বিমুক্ত হয়েন। দুই সন্ধ্যা এই উপক্রমণিকাধ্যায় পাঠ করিলে মনুষ্যেরা অহোরাত্র-সঞ্চিত পাপ হইতে অবশ্যই বিমুক্ত হয়। এই অধ্যায় ভারতের কলেবর; সত্য ও অমৃত উভয়ই ইহাতে প্রাপ্ত হ‌ইয়া যায়। দধির মধ্যে নবনীত, দ্বিপদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বেদচতুষ্টয়ের মধ্যে আরণ্যক, ওষধির মধ্যে অমৃত, হ্রদের মধ্যে সমুদ্র, চতুষ্পদের মধ্যে ধেনু যাদৃশ শ্রেষ্ঠ, ইতিহাসের মধ্যে বেদব্যাস-প্রণীত মহাভারত তাদৃশ উৎকৃষ্ট। আস্তিক ব্যক্তি শ্রাদ্ধকালে ব্রাহ্মণগণকে ভারতসংহিতার অন্ততঃ একচরণ শ্রবণ করাইলেও তাহার পিতৃলোক তদ্দত্ত অন্নপানে পরিতৃপ্ত হয়েন। বিদ্যান্ ব্যক্তি কৃষ্ণদ্বৈপায়নপ্রোক্ত এই মহাভারত কহিয়া প্রচুর অর্থ লাভ করেন ও ঋণহত্যা প্রভৃতি অতিদুষ্কৃতি হইতে আশু বিমুক্ত হয়েন। যিনি প্রতি পর্ব্বাহে অতিপূতমনে ইহার কতিপয় অধ্যায় আবৃত্তি করেন, তিনি সমুদয় গ্রন্থ অধ্যয়ন না করিলেও তাহার সম্যক্ ফল লাভ করেন। যিনি শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে এই ভারতীয় শ্লোক শ্রবণ করেন, তিনি দীর্ঘ-জীবন, মহীয়সী কীর্ত্তি ও অন্তে স্বর্গবাস লাভ করেন।

পূর্ব্বে দেবতারা একদা সমবেত হইয়া তুলাযন্ত্রের একদিকে চারিবেদ ও অন্যদিকে এই ভারতসংহিতা রাখিলেন, কিন্তু পরিমাণকালে ভারতসংহিতা সরহস্য বেদচতুষ্টয় অপেক্ষা মহত্ত্ব ও ভারবত্ত্ব গুণে অধিক হইল, তদবধি দেবতারা ইহাকে মহাভারত বলিয়া নির্দ্দেশ করিলেন। তপস্যার অনুষ্ঠান পাপজনক নহে, অধ্যয়নে পাপ নাই, জীবিকার নিমিত্ত ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করাও পাপাচার নহে, কিন্তু এ সকল ভাবদূষিত হইলেই পাপের সঞ্চার হয়।

Back
Forward

ভজহরি ফিল্ম কপোরেশন - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

বউবাজার দিয়ে আসতে আসতে ভীমনাগের দোকানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল টেনিদা। আর নড়তে চায় না। আমি বললুম, রাস্তার মাঝখানে অমন করে দাঁড়ালে কেন? চলো।

—যেতে হবে? নিতান্তই যেতে হবে? —কাতর দৃষ্টিতে টেনিদা তাকাল আমার দিকে; প্যালা, তোর প্রাণ কি পাষাণে গড়া? ওই দ্যাখ, থরে-থরে সন্দেশ সাজানাে রয়েছে, থালার ওপর সোনালি রঙের রাজভোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে, রসের মধ্যে ডুব-সাঁতার কাটছে রসগোল্লা, পানতো। প্যালা রে—

আমি মাথা নেড়ে বললুম, চালাকি চলবে না। আমার পকেটে তিনটে টাকা আছে, ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ কিনতে হবে। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো এখন—

খিদে পেয়েছে রে! আচ্ছা, দুটো টাকা আমায় ধার দে, বিকেলে না হয় ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ—

কিন্তু ও সব কথায় ভােলবার বান্দা প্যালারাম বাড়ুজ্যে নয়। টেনিদাকে টাকা ধার দিলে সে-টাকাটা আদায় করতে পারে এমন খলিফা লোক দুনিয়ায় জন্মায়নি। পকেটটা শক্ত করে ঢেকে ধরে আমি বললুম, খাবারের দোকান চোখে পড়লেই তোমার পেট চাঁই-চাঁই করে ওঠে— ওতে আমার সিমপ্যাথি নেই। তা ছাড়া, এ-বেলা মকরধ্বজ না নিয়ে গেলে আমার ছেঁড়া কানটা সেলাই করে দেবে কে? তুমি?

রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা। —ব্রাহ্মণকে সক্কিলবেলা দাগ দিলি প্যালা— মরে তুই নরকে যাবি।

—যাই তো যাব। কিন্তু ছোটমামার কানমলা যে নরকের চাইতে ঢের মারাত্মক সেটা জানা আছে আমার। আর, কী আমার ব্ৰাহ্মণ রে! দেলখোসা রেস্তোরাঁয় বসে আস্ত-আস্ত মুরগির ঠ্যাং চিবুতে তোমায় যেন দেখিনি আমি!

—উঃ! সংসারটাই মরীচিকা-ভীমানাগের দোকানের দিকে তাকিয়ে শেষবার দৃষ্টিভোজন করে নিলে টেনিদা; নাঃ, বড়লোক না হলে আর সুখ নেই।

বিকেলে চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে সেই কথাই হচ্ছিল। ক্যাবলা গেছে কাকার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে, হাবুল সেন গেছে দাঁত তুলতে। কাজেই আছি আমরা দুজন। মনের দুঃখে দুঠোঙা তেলেভাজা খেয়ে ফেলেছে টেনিদা। অবশ্য পয়সাটা আমিই দিয়েছি। এবং আধখানা আলুর চাপ ছাড়া আর কিছুই আমার বরাতে জোটেনি।

আমার পাঞ্জাবি আস্তিনটা টেনে নিয়ে টেনিদা মুখটা মুছে ফেলল। তারপর বললে, বুঝলি প্যালা, বড়লোক না হলে সত্যিই আর চলছে না।

—বেশ তো হয়ে যাও-না। বড়লোক— আমি উৎসাহ দিলুম।

—হয়ে যাও-না! —বড়লোক হওয়াটা একেবারে মুখের কথা কিনা! টাকা দেবে কে, শুনি? তুই দিবি?— টেনিদা ভেংচি কাটল। আমি মাথা নেড়ে জানালুম, না আমি দেব না।

—তবে?

—লটারির টিকিট কেনো। — আমি উপদেশ দিলুম।

—ধ্যাত্তোর লটারির টিকিট! কিনে-কিনে হয়রান হয়ে গেলুম, একটা ফুটো পয়সাও যদি জুটত কোনও বার! লাভের মধ্যে টিকিটের জন্যে বাজারের পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লুম, বড়দা দুটো অ্যায়সা থাপ্পড় কষিয়ে দিলে। ওতে হবে না—বুঝলি? বিজনেস করতে হবে।

—বিজনেস!

—আলবাত বিজনেস। —টেনিদার মুখ সংকল্পে কঠোর হয়ে উঠল; ওই যে কী বলে, হিতোপদেশে লেখা আছে না, বাণিজ্যে বসতে ইয়ে— মানে লক্ষ্মী! ব্যবসা ছাড়া পথ নেই— বুঝেছিস?

—তা তো বুঝেছি। কিন্তু তাতেও তো টাকা চাই।

—এমন বিজনেস করবে। যে নিজের একটা পয়সাও খরচ হবে না। সব পরস্মৈপদী— মানে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে।

—সে আবার কী বিজনেস?—আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলুম।

—হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি? –চোখ কুঁচকে মিটমিটি হাসতে লাগল টেনিদা; বলতে পারলি না তো? ও—সব কি তোর মতো নিরেট মগজের কাজ? এমনি একটা মাথা চাই, বুঝলি?

সগৌরবে টেনিদা নিজের ব্ৰহ্মতালুতে দুটো টোকা দিলে।

—কেন অযথা ছলনা করছ? বলেই ফেলো না— আমি কাতর হয়ে জানতে চাইলুম।

টেনিদা একবার চারদিকে তাকিয়ে ভালো বরে দেখে নিলে, তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ফিলিম কোম্পানি!

অ্যাঁ! —আমি লাফিয়ে উঠলাম।

—গাধার মতো চ্যাঁচাসনি— টেনিদা ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল; সব প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। তুই গল্প লিখবি— আমি ডাইরেকট —মানে পরিচালনা করব। দেখবি, চারিদিকে হইহই পড়ে যাবে।

—ফিলিমের কী জানো তুমি? আমি জানতে চাইলুম।

—কেইবা জানে? —টেনিদা তাচ্ছিল্যভরা একটা মুখ ভঙ্গি করলে; সবাই সমান— সকলের মগজেই গোবর। তিনটে মারামারি, আটটা গান আর গোটা কতক ঘরবাড়ি দেখালেই ফিলিম হয়ে যায়। টালিগঞ্জে গিয়ে আমি শুটিং দেখে এসেছি তো।

—কিন্তু তবুও—

—ধ্যাৎ, তুই একটা গাড়ল। —টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, সত্যি-সত্যিই কি আর ছবি তুলব আমরা! ও-সব ঝামেলার মধ্যে কে যাবে!

—তা হলে?

—শেয়ার বিক্রি করব। বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করতে পারলে— বুঝলি তো? —টেনিদা চোখ টিপল; দ্বারিক, ভীমনাগ, দেলখোস, কে. সি. দাস—

এইবার আমার নোলায় জল এসে গেল। চুক চুক করে বললুম— থাক, থাক আর বলতে হবে না।

পরদিন গোটা পাড়াটাই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল।

“দি ভজহরি ফিলিম কর্পোরেশন”

আসিতেছে-আসিতেছে

রোমাঞ্চকর বাণীচিত্র

“বিভীষিকা”!


পরিচালনা : ভজহরি মুখোপাধ্যায়। (টেনিদা)

 

কাহিনী : প্যালারাম বন্দ্যোপাধ্যায়

 

তার নীচে ছোট ছোট হরফে লেখা:

সর্বসাধারণকে কোম্পানির শেয়ার কিনিবার জন্য অনুরোধ জানানো হইতেছে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য মাত্র আট আনা। একত্রে তিনটি শেয়ার কিনিলে মাত্র এক টাকা।

এর পরে একটা হাত এঁকে লিখে দেওয়া হয়েছে; বিশেষ দ্রষ্টব্য— শেয়ার কিনিলে প্রত্যেককেই বইতে অভিনয়ের চান্স দেওয়া হইবে। এমন সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। মাত্ৰ অল্প শেয়ার আছে, এখন না কিনিলে পরে পস্তাইতে হইবে। সন্ধান করুন— ১৮ নং পটলডাঙা স্ট্রিট, কলিকাতা।

আর, বিজ্ঞাপনের ফল যে কত প্ৰত্যক্ষ হতে পারে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাতেনাতে তার প্রমাণ মিলে গেল। এমন প্ৰমাণ মিলল যে প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি। অত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা আমরা আশা করিনি। টেনিদাদের এত বড় বাড়িটা। একেবারে খালি, বাড়িসুদ্ধ সবাই গেছে দেওঘরে, হাওয়া বদলাতে। টেনিদার ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে, তাই একা রয়ে গেছে বাড়িতে, আর আছে চাকর বিষ্ট। তাই দিব্যি আরাম করে বসে আমরা তেতলার ঘরে রেডিয়ো শুনছি আর পাঁঠার ঘুগনি খাচ্ছি। এমন সময় বিষ্ট খবর নিয়ে এল মূর্তিমান একটি ভগ্নদূতের মতো।

বিষ্টুর বাড়ি চাটগাঁয়। হাঁইমাই করে নাকি সুরে কী যে বলে ভালো বোঝা যায় না। তবু যেটুকু বোঝা গেল, শুনে আমরা আঁত়্কে উঠলুম। গলায় পাঁঠার ঘুগনি বেঁধে গিয়ে মস্ত একটা বিষম খেল টেনিদা।

বিষ্টু জানাল : আঁড়িত ডাঁহাইত হইড়ছে (বাড়িতে ডাকাত পড়েছে)।

বলে কী ব্যাটা! পাগল না পেট খারাপ! ম্যাড়া না মিরগেল! এই ভর দুপুর বেলায় একেবারে কলকাতার বুকের ভেতরে ডাকাত পড়বে কী রকম।

বিষ্টু বিবৰ্ণ মুখে জানাল : নীচে হাঁসি দেইক্যা যান (নীচে এসে দেখে যান)। —

আমি ভেবেছিলাম খাটের তলাটা নিরাপদ কিনা, কিন্তু টেনিদা এমন এক বাঘা হাঁকার ছাড়লে যে আমার পালাজ্বরের পিলেটা দস্তুর মতো হকচকিয়ে উঠল।

—কাপুরুষ! চলে আয় দেখি— একটা বোম্বাই ঘুষি হাঁকিয়ে ডাকাতের নাক ন্যাবড়া করে দি!— আমি নিতান্ত গোবেচারা প্যালারাম বাড়ুজ্যে, শিংমাছের ঝোল খেয়ে প্ৰাণটাকে কোনওমতে ধরে রেখেছি, ওসব ডাকাত-ফাকাতের ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। বেশ তো ছিলাম, এসব ভজঘট ব্যাপার কেন রে বাবা। আমি বলতে চেষ্টা করলুম, এই—এই মানে, আমার কেমন পেট কামড়াচ্ছে—

—পেট কামড়াচ্ছে! টেনিদা গর্জন করে উঠল : পাঁঠার ঘুগনি সাবাড় করার সময় তো সে কথা মনে ছিল না দেখছি। চলে আয় প্যালা, নইলে তোকেই আগে—

কথাটা টেনিদা শেষ করল না, কিন্তু তার বক্তব্য বুঝতে বেশি দেরি হল না আমার। “জয় মা দুর্গা”—কাঁপতে-কাঁপতে আমি টেনিদাকে অনুসরণ করলুম।

কিন্তু না— ডাকাত পড়েনি। পটলডাঙার মুখ থেকে কলেজ স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত “কিউ!”

কে নেই সেই কিউতে? স্কুলের ছেলে, মোড়ের বিড়িওয়ালা, পাড়ার ঠিকে ঝি, উড়ে ঠাকুর, এমন কি যমদূতের মত দেখতে এক জোড়া ভীম-দৰ্শন কাবুলিওয়ালা।

আমরা সামনে এসে দাঁড়াতেই গগনভেদী কোলাহল উঠল।

—আমি শেয়ার কিনব—

—এই নিন মশাই আট আনা পয়সা—

ঝি বলল, ওগো বাছারা, আমি এক ট্যাকা এনেছি। আমাদের তিনখানা শেয়ার দাও— আর একটা হিরোইনের চান্স দিয়ো—

পাশের বোর্ডিংটার উড়ে ঠাকুর বললে, আমিও আষ্টো গণ্ডা পয়সা আনুচি—

সকলের গলা ছাপিয়ে কাবুলিওয়ালা রুদ্র কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ল : এঃ বাব্বু, এক এক রূপায়া লায়া, হামকো ভি চান্স চাহিয়ে—

তারপরেই সমস্বরে চিৎকার উঠল; চান্স-চান্স। চিৎকারের চোখে আমার মাথা ঘুরে গেল— দুহাতে কান চেপে আমি বসে পড়লুম।

আশ্চৰ্য, টেনিদা দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রইল একেবারে শান্ত, স্তব্ধ বুদ্ধদেবের মতো। শুধু তাই নয়, এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত একটা দাঁতের ঝলক বয়ে গেল তার— মানে হাসল।

তারপর বললে, হবে, হবে, সকলেরই হবে,—বরাভয়ের মতো একখানা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, প্রত্যেককেই চান্স দেওয়া হবে। এখন চাঁদেরা আগে সুড়সুড়ি করে পয়সা বের করো দেখি। খবরদার, অচল আধুলি চালিয়ো না,—তাহলে কিন্তু—

—জয় হিন্দ--জয় হিন্দ—

ভিড়টা কেটে গেলে টেনিদা দু হাত তুলে নাচতে শুরু করে দিলে। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসতে গিয়ে চেয়ারসুদ্ধই চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল।

আমি বললুম, আহা-হা— কিন্তু টেনিদা উঠে পড়েছে ততক্ষণে। আমার কাঁধের ওপর এমন একটা অতিকায় থাবড়া বসিয়ে দিলে যে, আমি আর্তনাদ করে উঠলুম।

—ওরে প্যালা, আজ দুঃখের দিন নয় রে, বড় আনন্দের দিন। মার দিয়া কেল্লা! ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ, চাচার হােটেল, দেলখোস-আঃ!

যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে আমিও বললুম, আঃ!

—মায় গুনে দেখি—এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত আবার হাসির কলকা উলসে রোজগার নেহাত মন্দ হয়নি। গুনে দেখি, ছব্বিশ টাকা বারো আনা।

—বারো আনা? —টেনিদা ভ্রূকুটি করলে, বারো আনা কী করে হয়? আট আনা এক টাকা করে হলে— উহুঁ! নিশ্চয় ডামাডোলের মধ্যে কোনও ব্যাটা চার গণ্ডা পয়সা ফাঁকি দিয়েছে— কী বলিস?

আমি মাথা নেড়ে জানালুম, আমারও তাই মনে হয়। —উঃ—দুনিয়ায় সবই জোচ্চোর। একটাও কি ভালো লোক থাকতে নেইরে? দিলো সক্কালবেলাটায় বামুনের চার চার আনা পয়সা ঠকিয়ে। —টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : যাক, এতেও নেহাত মন্দ হবে না। দেলখোস, ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ—

আমি তার সঙ্গে জুড়ে দিলুম, চাচার হােটেল, কে সি দাস—

টেনিদা বললে, ইত্যাদি— ইত্যাদি। কিন্তু শোন প্যালা, একটা কথা আগেই বলে রাখি। প্ল্যানটা আগাগোড়াই আমার। অতএব বাবা সোজা হিসেব— চৌদ্দ আনা—দু আনা।

আমি আপত্তি করে বললুম, অ্যাঁ, তা কী করে হয়?

টেনিদা সজোরে টেবিলে একটা কিল মেরে গর্জন করে উঠল, হুঁ, তাই হয়! আর তা যদি না হয়, তাহলে তোকে সোজা দোতালার জানালা গলিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া হয়, সেটাই কি তবে ভালো হয়?

আমি কান চুলকে জানালুম, না সেটা ভালো হয় না!

—তবে চল— গোটা কয়েক মোগলাই পরোটা আর কয়েক ডিশ ফাউল কারি খেয়ে ভজহরি ফিলম কপোরেশনের মহরত করে আসি—

টেনিদা ঘর-ফাটানো একটা পৈশাচিক অট্টহাসি করে উঠল। হাসির শব্দে ভেতর থেকে ছুটে এল বিষ্টু। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, ছটো বাবুর মাথা হাঁড়াপ। (খারাপ) অইচে!——

কিন্তু—দিন কয়েক বেশ কেটে গেল। দ্বারিকের রাজভোগ আর চাচার কাটলেট খেয়ে শরীরটাকে দস্তুরমতো ভালো করে ফেলেছি দুজনে। কে. সি. দাসের রসমালাই খেতে খেতে দুজনে ভাবছি— আবার নতুন কোনও একটা প্ল্যান করা যায় কি না, এমন সময়—

দোরগোড়ায় যেন বাজ ডেকে উঠল। সেই যমদূতের মতো একজোড়া কাবুলিওয়ালা। অতিকায় জাব্বা-জোব্বা আর কালো চাপদাড়ির ভেতর দিয়ে যেন জিঘাংসা ফুটে বেরোচ্ছে।

আমরা ফিরে তাকাতেই লাঠি ঠুকল : এঃ বাব্বু— রূপেয়া কাঁহা—হামলোগ গা চান্স কিধর?

—অ্যাঁঃ! —টেনিদার হাত থেকে রসমালাইটা বুক-পকেটের ভেতর পড়ে গেল : প্যালা রে, সেরেছে!

—সারবেই তো! —আমি বললুম, তবে আমার সুবিধে আছে। চৌদ্দ আনা দু আনা। চৌদ্দ আনা ঠ্যাঙনি তোমার, মানে স্রেফ ছাতু করে দেবে। দু, আনা খেয়ে আমি বাঁচলেও বেঁচে যেতে পারি।

কাবুলিওয়ালা আবার হাঁকল :—এঃ ভজহরি বাব্বু— বাহার তো আও— বাহার আও—মানেই নিমতলা যাও! টেনিদা এক লাফে উঠে দাঁড়াল, তারপর সোজা আমাকে বগলদাবা করে পাশের দরজা দিয়ে অন্যদিকে।

—ওগো ভালো মানুষের বাছারা, আমার ট্যাকা। কই, চান্স কই? ঝি হাতে আঁশবটি নিয়ে দাঁড়িয়ে।

—আমারো চান্সো মিলিবো কি না?—উড়ে ঠাকুর ভাত রাঁধবার খুন্তিটাকে হিংস্রভাবে আন্দোলিত করল।

—জোচ্চুরি পেয়েছেন স্যার—আমরা শ্যামবাজারের ছেলে— আস্তিন গুটিয়ে একদল ছেলে তাড়া করে এল।

এক মুহুর্তে আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন ঘুরতে লাগল। তারপরেই —‘করেঙ্গে ইয়া মারেঙ্গে!’ আমাকে কাঁধে তুলে টেনিদা একটা লাফ মারল। তারপর আমার আর ভালো করে জ্ঞান রইল না। শুধু টের পেলুম, চারিদিকে একটা পৈশাচিক কোলাহল; চোট্টা—চোট্টা—ভাগ যাতা—আর বুঝতে পারলুম— যেন পাঞ্জাব মেলে চড়ে উড়ে চলেছি।

ধপাৎ করে মাটিতে পড়তেই আমি হিউমাউ করে উঠলুম। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, হাওড়া স্টেশন। রেলের একটা ইঞ্জিনের মতোই হাঁপাচ্ছে টেনিদা।

বললে, হুঁ হুঁ বাবা, পাঁচশো মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন— আমাকে ধরবে ওই ব্যাটারা! যা প্যালা- পকেটে এখনও বারো টাকা চার আনা রয়েছে, ঝট করে দুখানা দেওঘরের টিকিট কিনে আন। দিল্লি এক্সপ্রেস এখুনি ছেড়ে দেবে।

চামচিকে আর টিকিট চেকার - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

—বুঝলি প্যালা, চামচিকে ভীষণ ডেঞ্জারাস!...

একটা ফুটো শাল পাতায় করে পটলডাঙার টেনিদা ঘুগনি খাচ্ছিল। শালপাতার তলা দিয়ে হাতে খানিক ঘুগনির রস পড়েছিল, চট করে সেটা চেটে নিয়ে পাতাটা তালগোল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলে ক্যাবলার নাকের ওপর। তারপর আবার বললে, হুঁ হুঁ, ভীষণ ডেঞ্জারাস চামচিকে।

—কী কইর‌্যা বোঝলা—কও দেখি?—

বিশুদ্ধ ঢাকাই ভাষায় জানতে চাইল হাবুল সেন।

—আচ্ছা, বল চামচিকের ইংরেজি কি?

আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

—বল না!

শেষকালে ভেবে-চিন্তে ক্যাবলা বললে, স্মল ব্যাট। মানে ছােট বাদুড়!

—তোর মুণ্ডু।

—আমি বললাম, তবে ব্যাটলেট। তা-ও নয়? তা হলে? ব্যাটস সান—মানে, বাদুড়ের ছেলে? হল না? আচ্ছা, ব্রিক ব্যাট কাকে বলে?

টেনিদা বললে থাম উল্লুক! ব্রিক ব্যাট হল থান ইট! এবার তাই একটা তোর মাথায় ভাঙব।

হাবুল সেন গভীর মুখে বললে, হইছে।

—কী হল?

—স্কিন মোল।

—স্কিন মোল?...টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে মনুমেন্টের মতো উঁচু করে ধরল, সে আবার কী?

—স্কিন মনে হইল চাম— অর্থাৎ কিনা চামড়া। আর আমাগো দ্যাশে ছুঁচারে কয় চিকা— মোল। দুইটা মিলাইয়া স্কিন মোল।

টেনিদা খেপে গেল : দ্যাখা হাবুল, ইয়ার্কির একটা মাত্রা আছে, বুঝলি? স্কিন মোল। ইঃ—গবেষণার দৌড়টা দেখ একবার।

আমি বললাম, চামচিকের ইংরেজী কী তা নিয়ে আমাদের জ্বালাচ্ছ কেন? ডিক্সনারি দ্যাখো গে!

—ডিক্সনারিতেও নেই। —টেনিদা জয়ের হাসি হাসল।

—তা হলে?

—তা হলে এইটাই প্রমাণ হল চামচিকে কী ভীষণ জিনিস। অর্থাৎ এমন ভয়ানক যে চামচিকাকে সাহেবরাও ভয় পায়! মনে কর না— যারা আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে সিংহ আর গরিলা মারে, যারা যুদ্ধে গিয়ে দমদম বোমা আর কামান ছোড়ে, তারা সুদ্ধ চামচিকের নাম করতে ভয় পায়। আমি নিজের চোখেই সেই ভীষণ ব্যাপারটা দেখেছি।

কী ভীষণ ব্যাপার?—গল্পের গন্ধে আমরা তিনজনে টেনিদাকে চেপে ধরলাম: বলো এক্ষুনি।

—ক্যাবলা, তাহলে চটপট যা। গলির মোড় থেকে আরও দুআনার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়। রসদ না হলে গল্প জমবে না।

ব্যাজার মুখে ক্যাবলা ঘুগনি আনতে গেল। দু’আনার ঘুগনি একাই সবটা চেটেপুটে খেয়ে, মানে আমাদের এক ফোঁটাও ভাগ না দিয়ে, টেনিদা শুরু করলে : তবে শোন—

সেবার পাটনায় গেছি ছোটমামার ওখানে বেড়াতে। ছোটমামা রেলে চাকরি করে— আসার সময় আমাকে বিনা টিকিটেই তুলে দিলে দিল্লি এক্সপ্রেসে। বললে, গাড়িতে চ্যাটার্জি যাচ্ছে ইনচার্জ— আমার বন্ধু। কোনও ভাবনা নেই-সেই-ই তোকে হাওড়া স্টেশনের গেট পর্যন্ত পার করে দেবে!

নিশ্চিন্ত মনে আমি একটা ফাঁকা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় চড়ে লম্বা হয়ে পড়লাম।

শীতের রাত। তার ওপর পশ্চিমের ঠাণ্ডা— হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি ধরায়।

কিন্তু কে জানত— সেদিন হঠাৎ মাঝপথেই চ্যাটার্জির ডিউটি বদলে যাবে। আর তার জায়গায় আসবে—কী নাম ওর— মিস্টার রাইনোসেরাস।

ক্যাবলা বললে, রাইনোসেরাস মানে গণ্ডার।

—থাম, বেশি বিদ্যে ফলাসনি। ...টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, যেন ডিক্সনারি একেবারে। সায়েবের বাপ-মা যদি ছেলের নাম গণ্ডার রাখে— তাতে তোর কী র‌্যা? তোর নাম যে কিশলয় কুমার না হয়ে ক্যাবলা হয়েছে, তাতে করে কী ক্ষেতি হয়েছে শুনি?

হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও— ছাড়ান দাও। পোলাপান!

—হুঁ, পোলাপান! আবার যদি বকবক করে তো জলপান করে ছাড়ব! যাক— শোন। আমি তো বেশ করে গাড়ির দরজা-জানালা এঁটে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। একে দুখানা - কম্বলে শীত কাটছে না, তার ওপরে আবার খাওয়াটাও হয়ে গেছে বড্ড বেশি। মামাবাড়ির কালিয়ার পাঠাটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে গাড়ির তালে তালে পেটের ভেতর শিং দিয়ে ঢুঁ মারছে। লোভে পড়ে অতটা না খেয়ে ফেলেই চলত।

পেট গরম হয়ে গেলেই লোকে নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখে— জানিস তো? আমিও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আমার পেটের ভেতরে সেই যে বাতাপি না ইল্বল কে একটা ছিল— সেইটে পাঁঠা হয়ে ঢুকেছে। একটা রাক্ষস হিন্দি করে বলছে : এ ইল্বল— আভি ইসকো পেট ফাটাকে নিকাল আও—

—বাপরে— বলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। চোখ চেয়ে দেখি, গাড়ির ভেতরে বাতাপি বা ইম্বল কেউ নেই-— শুধু ফর-ফর করে একটা চামচিকে উড়ছে। একেবারে বোঁ করে আমার মুখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল-নাকটাই খিমচে ধরে আর কি!

এ তো আচ্ছা উৎপাত।

কোন দিক দিয়ে এল কে জানে? চারিদিকে তো দরজা-জানালা সবই বন্ধ। তবে চামচিকের পক্ষে সবই সম্ভব। মানে অসাধ্য কিছু নেই।

একবার ভাবলাম, উঠে। ওটাকে তাড়াই। কিন্তু যা শীত—কম্বল ছেড়ে নড়ে কার সাধ্যি। তা ছাড়া উঠতে গেলে পেট ফুঁড়ে শিং-টিং সুদ্ধু পাঁঠাটাই বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। তারপর আবার যখন সাঁ করে নাকের কাছে এল, তখন বসে পড়ে আর কি। আমার খাড়া নাকটা দেখে মনুমেন্টের ডগাই ভাবল বোধ হয়।

আমি বিচ্ছিরি মুখ করে বললাম, ফর-র-ফুস! —মনে চামচিকেটিকে ভয় দেখলাম। তাইতেই আঁতকে গেল কি না কে জানে— সাঁ করে গিয়ে ঝুলে রইল একটা কোট-হ্যাঙ্গারের সঙ্গে। ঠিক মনে হল, ছােট একটা কালো পুটলি ছুলছে!

এত রাত্তিরে কে আবার জ্বালাতে এল? নিশ্চয় কোনও প্যাসেঞ্জার। প্রথমটায় ভাবলাম, পড়ে থাকি ঘাপটি মেরে। যতক্ষণ খুশি খটখটিয়ে কেটে পড়ুক লোকটা। আমি কম্বলের ভেতরে মুখ ঢোকালাম।

কিন্তু কী একটা যাচ্ছেতাই স্টেশনে যে গাড়িটা থেমেছে কে জানে! সেই যে দাঁড়িয়ে আছে—একদম নট নড়ন-চড়ন! যেন নেমন্তন্ন খেতে বসেছে! ওদিকে দরজায় খটখটানি সমানে চলতে লাগল। ভেঙে ফেলে আর কি!

এমন বেয়াক্কেলে লোক তো কখনও দেখিনি! ট্রেনে কি আর কামরা নেই যে এখানে এসে মাথা খুঁড়ে-মরছে! ভারি রাগ হল। দরজা না খুলেও উপায় নেই— রিজার্ভ গাড়ি তো নয় আর। খুব কড়া গলায় হিন্দীতে একটা গালাগাল দেব মনে করে উঠে পড়লাম।

ক্যাবলা হঠাৎ বাঁধা দিয়ে বললে, তুমি মোটেই হিন্দী জানো না টেনিদা!

—মানে।

—তুমি যা বলে তা একেবারেই হিন্দী হয় না। আমি ছেলেবেলা থেকে পশ্চিমে ছিলাম—

—চুপ কর বলছি ক্যাবলা!—টেনিদা। হুঙ্কার ছাড়ল ; ফের যদি ভুল ধরতে এসেছিস তো এক চাঁটিতে তোকে চাপাটি বানিয়ে ফেলব! আমার হিন্দী শুনে বাড়ির ঠাকুর পর্যন্ত ছাপরায় পালিয়ে গেল, তা জানিস?

হাবুল বললে, ছাইড়্যা দাও— চ্যাংড়ার কথা কি ধরতে আছে?

—চ্যাংড়া! চিংড়িমাছের মতো ভেজে খেয়ে ফেলব! আমি বললাম, ওটা অখাদ্য জীব— খেলে পেট কামড়াবে, হজম করতে পারবে না। তার চেয়ে গল্পটা বলে যাও।

—হুঁ, শোন! —টেনিদা ক্যাবলার ছ্যাবলামি দমন করে আবার বলে চলল : উঠে দরজা খুলে যেই বলতে গেছি— এই আপ কেইসা আদমি। হ্যায়— সঙ্গে সঙ্গে গাঁক গাঁক করে আওয়াজ!

—গাঁক—গাঁক?

—মানে সায়েব। মানে টিকিট চেকার।

—সেই রাইনোসেরাস? বকুনি খেয়েও ক্যাবলা সামলাতে পারল না।

—আবার কে? একদম খাঁটি সায়েব-পা থেকে মাথা ইস্তক।

সেই যে একরকম সায়েব আছে না? গায়ের রং মোষের মতো কালো, ঘামলে গা দিয়ে কালি বেরোয়— তাদের দেখলে সায়েবের ওপরে ঘেন্না ধরে যায়— মোটেই সে-রকমটি নয়। চুনকাম করা ফর্সা রঙ— হাঁড়ির মতো মুখ, মোটা নাকের ছাঁদায় বড় বড় লালচে লোম— হাসলে মুখ ভর্তি মুলো দেখা যায়, আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে— একেবারে সেই জিনিসটি! ঢুকেই চোস্ত ইংরেজীতে আমাকে বললে, এই সন্ধেবেলাতেই এমন করে ঘুমোচ্ছ কেন? এইটেই সবচেয়ে বিচ্ছিরি হ্যাবিট।

—কী রকম চোস্ত ইংরেজী টেনিদা? আমি জানতে চাইলাম।

—সে-সব শুনে কী করবি?...টেনিদা উঁচু দরের হাসি হাসল! শুনেও কিছু বুঝতে পারবি না-সায়েবের ইংরেজী কিনা! সে যাক। সায়েবের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠল রাত বারোটাকে বলছে সন্ধেবেলা। তা হলে ওদের রাত্তির হয়। কখন? সকালে নাকি?

তারপরেই সায়েব বললে, তোমার টিকিট কই?

আমার তো তৈরী জবাব ছিলই। বললাম, আমি পাটনার বাঁড়ুজ্যে মশাইয়ের ভাগনে। আমার কথা ক্রু-ইন-চার্জ চাটুজ্যেকে বলা আছে।

তাই শুনে সায়েবটা এমনি দাঁত খিঁচোল যে, মনে হল মুলোর দোকান খুলে বসেছে। নাকের

লোমের ভেতরে যেন ঝড় উঠল, আর বেরিয়ে এল খানিকটা গর-গরে আওয়াজ!

যা বললে, শুনে তো আমার চোখ চড়ক গাছ।

—তােমার বাড়ুজ্যে মামাকে আমি থোরাই পরোয়া করি! এসব ডাবলুটিরা ও-রকম ঢের মামা পাতায়। তা ছাড়া চাটুজ্যের ডিউটি বদল হয়ে গেছে— আমিই এই ট্রেনের ক্রু-ইন-চার্জ। অতএব চালাকি রেখে পাটনা-টু-হাওড়া সেকেন্ড ক্লাস ফেয়ার আর বাড়তি জরিমানা বের করো।

পকেটে সব সুদ্ধ পাঁচটা টাকা আছে— সেকেন্ড ক্লাস দূরে থাক, থার্ড ক্লাসের ভাড়াও হয় না ; সর্ষের ফুল এর আগে দেখিনি— এবার দেখতে পেলাম! আর আমার গা দিয়ে সেই শীতেও দরদর করে সর্ষের তেল পড়তে লাগল।

আমি বলতে গেলাম, দ্যাখো সায়েব—

সায়েব সায়েব বোলো না—আমার নাম মিস্টার রাইনোসেরাস। আমার গণ্ডারের মতো গোঁ। ভাড়া যদি না দাও— হাওড়ায় নেমে তোমায় পুলিশে দেব। ততক্ষণে আমি গাড়িতে চাবি বন্ধ করে রেখে যাচ্ছি।

—কী বলব জানিস প্যালা— আমি পটলডাঙার টেনিরাম— অমন ঢের সায়েব দেখেছি। ইচ্ছে করলেই সায়েবকে ধরে চলতি গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা বোষ্টুম— জীবহিংসা করতে নেই, তাই অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিলাম।

হাবুল সেন বলে বসল ; জীবহিংসা কর না, তবে পাঁঠা খাও ক্যান?

—আরে পাঠার কথা আলাদা। ওরা হল অবোলা জীব, বামুনের পেটে গেলে স্বর্গে যায়। পাঁঠা খাওয়া মানেই জীবে দয়া করা! সে যাক। কিন্তু সায়েবকে নিয়ে এখন আমি করি কী? এ তো আচ্ছা প্যাঁচ কষে বসেছে! শেষকালে সত্যিই জেলে যেতে না হয়!

কিন্তু ভগবান ভরসা!

পকেট থেকে একটা ছোট খাতা বের করে সায়েব কী লিখতে যাচ্ছিল পেনসিল দিয়ে হঠাৎ সেই শব্দ—ফর-ফর—ফরাৎ!

চামচিকেটা আবার উড়তে শুরু করেছে। আমার মতোই তো বিনাটিকিটের যাত্রী— চেকার দেখে ভয় পেয়েছে নিশ্চয়।

আর সঙ্গে সঙ্গেই সায়েব ভয়ানক চমকে উঠল। বললে, ওটা কী পাখি? জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, চামচিকে— কিন্তু তার আগেই সায়েব হাইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল। নাকের দিকে চামচিকের এত নজর কেন কে জানে— ঠিক সায়েবের নাকেই একটা ঝাপটা মেরে চলে গেল।

ওটা কী পাখি? কী বদখত দেখতে - সায়েব কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল! চুনকাম-করা মুখটা তার ভয়ে পানসে হয়ে গেছে।

আমি বুঝলাম এই মওক! বললাম, তুমি কি ও-পাখি। কখনও দ্যাখোনি?

—নো—নেভার! আমি মাত্ৰ ছমাস আগে আফ্রিকা থেকে ইণ্ডিয়ায় এসেছি। সিংহ দেখেছি— গণ্ডার দেখেছি— কিন্তু—

সায়েব শেষ করতে পারল না। চামচিকেটা আর একবার পাক খেয়ে গেল। একটু হলেই প্রায় খিমচে ধরেছিল সায়েবের মুখ। বোধহয় ভেবেছিল, ওটা চালকুমড়ো।

সায়েব বললে, মিস্টার— ও কি কামড়ায়?

আমি বললাম, মোক্ষম। ভীষণ বিষাক্ত! এক কামড়েই লোক মারা যায়। এক মিনিটের মধ্যেই।

—হােয়াট! —বলে সায়েব লাফিয়ে উঠল। তারপরে আমার কম্বল ধরে টানাটানি করতে লাগল।

—মিস্টার—প্লিজ—ফর গডস সেক— আমাকে একটা কম্বল দাও।

—তারপর আমি ওর কামড়ে মারা যাই আর কি ৷ ও সব চলবে না! —আমি শক্ত করে কম্বল চেপে রইলাম!

—অ্যাঁ? তা হলে!— বলেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল সায়েব। বোঁ করে একেবারে চেন ধরে ঝুলে পড়ল প্ৰাণপণে। তারপর জানলা খুলে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল। : হেলপ—হেলপ—আর খোলা জানলা পেয়েই সাহেবের কাঁধের ওপর দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চামচিকে ভ্যানিস!

সায়েব খানিকক্ষণ। হতভম্ব হয়ে রইল। একটু দম নিয়ে মস্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, যাক— স্যামসিকেটা বাইরে চলে গেছে। এখন আর ভয় নেইকী বলে?

আমি বললাম, না, তা নেই। তবে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দেবার জন্য তৈরি থাকো।

সাহেবের মুখ হাঁ হয়ে গেল : কেন?

—বিনা কারণে চেন টেনেছ— গাড়ি থামল বলে! আর শোনো সায়েব— চামচিকে খুব লক্ষ্মী পাখি। কাউকে কামড়ায় না—কাউকে কিছু বলে না। তুমি রেলের কর্মচারী হয়ে চামচিকে দেখে চেন টেনেছ— এ জন্যে তোমার শুধু ফাইন নয়— চাকুরিও যেতে পারে।

ওদিকে গাড়ি আস্তে আস্তে থেমে আসছে তখন। মিস্টার রাইনােসেরাস কেমন মিটমিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ভয়ে এখন প্রায় মিস্টার হেয়ার—মানে খরগোশ হয়ে গেছে।

তারপরই আমার ডান হাত চেপে ধরল দুহাতে। —শোনো মিস্টার, আজ থেকে তুমি আমার বুজুম ফ্রেণ্ড! মানে প্ৰাণের বন্ধু। তোমাকে আমি ফাস্ট ক্লাস সেলুনে নিয়ে যাচ্ছি— দেখবে তোফা ঘুম দেবে। হাওড়ায় নিয়ে গিয়ে কোলনারের ওখানে তোমাকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। শুধু গার্ড এলে বলতে হবে, গাড়িতে একটা গুণ্ডা পিস্তল নিয়ে ঢুকেছিল, তাই আমরা চেন টেনেছি। বলো — রাজি?

রাজি না হয়ে আর কী করি! এত করে অনুরোধ করছে যখন।

বিজয়গর্বে হাসলে টেনিদা : যা ক্যাবলা— আর চার পয়সার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়।

বিষয় ভিত্তিক বিভাগ